নবীপ্রেমের নগদ উপহার | যে গল্পে হৃদয় গলে

প্রিয় নবীজীর সাচ্চা প্রেমিক হযরত ইমাম বুসিরী রহ.। তাঁর বিশাল হৃদয়ের সবটুকু ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, কানায় কানায় ভরা। বহু ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন তিনি। কবি হিসেবেও তাঁর ছিল অসাধারণ খ্যাতি। একবার তিনি অসুস্থ হলেন। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হলেন। অচল হয়ে বিছানায় আশ্রয় নিলেন। চিকিৎসা চলল। নানা রকমের চিকিৎসা। দু’চার দিন নয়, দীর্ঘদিন। সুস্থতার কোনো লক্ষণ নেই। ভালো হওয়ার কোনো নাম-গন্ধ নেই। সকলেই নিরাশ। কিন্তু নিরাশ হলেন না এই নবীপ্রেমিক। ইমাম বুসিরী রহ. রোগমুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে সর্বশেষ তদবীরের কথা ভাবলেন।


সিদ্ধান্ত নিলেন, মাবুদের কাছে তিনি রোগমুক্তি কামনা করবেন। প্রিয়তম রাসূলের নামে সুস্থতা চাইবেন। তাঁর ওসিলায় আরোগ্য প্রার্থনা করবেন। এ ছিল তাঁর গভীর বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি। তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস, প্রিয়তম নবীর নাম নিয়ে দোয়া করে ব্যর্থ হবেন না তিনি। অসুস্থ এই নবীপ্রেমিক সীমাহীন অসুস্থতা নিয়ে দীর্ঘ এক কাসীদা রচনা করলেন। কাসীদা মানে কবিতা। কাসীদা লিখলেন নবীজীকে নিয়ে। নবীজীর সৌন্দর্য, প্রশংসা, আবির্ভাব, মে’রাজ ইত্যাদি নিয়ে। হৃদয়ে সঞ্চিত সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে লিখলেন। লিখলেন মনের মাধুরী মিশিয়ে।


জুমআ রাত। তিনি উত্তমরূপে পাক-পবিত্র হলেন। একাকী নির্জনে বসে পড়লেন। উদ্দেশ্য, প্রিয়তমের প্রশংসায় রচিত কাসীদাখানা আবৃত্তি করা। গভীর মনোযোগ, ভক্তি ও প্রাণনিংড়ানো আন্তরিকতা নিয়ে কাসীদা আবৃত্তি করতে শুরু করলেন। এবং একসময় অসুস্থ, বিকলপ্রায় কবি কাসীদা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লেন। খানিক পর। তিনি একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখলেন। দারুণ স্বপ্ন। দেখলেন, তাঁর ছোট্ট কুটিরখানা অপার্থিব এক আলোর বন্যায় উদ্ভাসিত।


আরো দেখলেন, দু‘ জাহানের সর্দার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ঘরে এসেছেন। শুভাগমন করেছেন। নবীজীকে দেখে কবি আনন্দে আত্মহারা। খুশির ঢেউ উথলে ওঠে তাঁর হৃদয়-মনে। তিনি এগিয়ে গেলেন নবীজীর দিকে। তারপর গভীর আবেগ নিয়ে স্বরচিত কাসীদাখানি নবীজীকে পাঠ করে শোনাতে থাকলেন।


কাসীদা পড়তে পড়তে এক সময় যখন পাঠ করলেন– “কতোই রোগ, হলো নিরাময় তাঁর হাতের পরশ মেখে কত পাগল মুক্তি পেল উম্মাদনার শেকল থেকে।” তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্র হাত বাড়ালেন তৃষ্ণার্ত আশেকের দিকে। মখমল কোমল হাতখানার ছোঁয়া আলতো করে বুলিয়ে দিলেন সারাটা দেহে। তারপর নিজের নক্শী করা ইয়ামানী চাদরখানা দিয়ে ঢেকে দিলেন কবির সমগ্র বদন। স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় কবির। জেগে ওঠেন তিনি। চারিদিকে তীক্ষ দৃষ্টি ফেলেন। অনুসন্ধানী চোখে রাসূলকে খুঁজে ফিরেন। কিন্তু কোথাও তাঁকে পেলেন না। তিনি নেই। সেই সাথে নেই কবি-দেহের রোগ-বালাও। তিনি এখন পূর্ণ সুস্থ। উপরন্তু তাঁর গায়ে শোভা পাচ্ছে প্রিয় নবীজীর দেওয়া ইয়ামানী চাদরখানা।


কী আশ্চর্য! কী অপূর্ব!! কবি বিস্মিত হলেন এবং মহান আল্লাহর শোকর আদায় করলেন। বাদ ফজর। কবি রওয়ানা দিলেন বাজারের দিকে। পথে এক দরবেশের সাথে দেখা। সালাম মোসাফাহা হলো। কুশল বিনিময় হলো। তারপর দরবেশ সাহেব কবির নিকট একটি আবেদন করে বসলেন। বললেন, প্রিয় নবীজীর শানে আপনি যে কবিতা লিখেছেন, তা কি আমাকে শোনাবেন? কবি বললেন, কবিতা তো অনেক দীর্ঘ। কোন্ দিক থেকে শোনাব? দরবেশ একটি লাইন আবৃত্তি করে বললেন, এখান থেকে শোনান। তাজ্জব হলেন কবি! বললেন, আমি তো এই কবিতা কাউকে শোনাইনি। কারো কাছে বলিনি। প্রকাশও করিনি। আপনি জানলেন কী করে?


দরবেশ বললেন, গতরাতে আপনি যখন নবীজীকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলেন, তখন সেখানে উপস্থিত থেকে আমিও তা শুনছিলাম। কেবল আমি নই, আল্লাহর অন্যান্য খাস বান্দারাও শুনেছেন। অবশ্য তাঁরা সবাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। আল্লাহ পাক প্রিয়নবীর শানে লেখা আপনার এই কবিতাকে এতই পছন্দ করেছেন যে, তখনই তিনি তার বিশেষ বান্দাদের কাছে তা পৌঁছে দিয়েছেন। এই ছিল ইমাম বুসিরী রহ.-এর রাসূল প্রেমের নগদ উপহার। তি


নি রাসূল প্রেমে আপ্লুত হয়ে যে কাসীদা রচনা করেছিলেন, আজও তা নবীপ্রেমীদের কণ্ঠে কণ্ঠে উচ্চারিত হয় প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে হজের মৌসুমে। আশেকানরা হৃদয়ের তপ্ত প্রেম নিবেদন করে এই কাসীদা আবৃত্তি করে। বিশ্বের সকল নবী প্রেমিকদের হৃদয়ের খোরাক এই কাসীদা। ‘কাসীদায়ে বুরদা’ নামে যা সমধিক পরিচিত!


প্রিয় পাঠক! আসুন, আমরাও আমাদের হৃদয়গুলোকে প্রিয়নবীজির ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলি। জীবন-সংসারের প্রতিটি অঙ্গনে ভালোবাসার প্রমাণ পেশ করি। হে দয়ার সাগর! তুমি আমাদের অন্তরে তোমার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহব্বত ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে দাও। আর সেই ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তাঁর নূরাণী সুন্নতগুলোর উপর আমল করার তাওফীক দাও। সেই সাথে ধন্য করো, স্বপ্নযোগে তাঁর দর্শন দিয়ে। [সূত্র : ফয়জুল বুরদাহ পৃষ্ঠা : ৭]

নবীনতর পূর্বতন