ইসলামে নারীর মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় পর্দা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এটি শুধুমাত্র পোশাকের একটি ধরন নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা নারীর পরিচয়, নিরাপত্তা, সম্মান ও আত্মমর্যাদার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ইসলামে পর্দা নারীকে সমাজে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান দেয় এবং তার ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক গুণাবলিকে রক্ষা করে।
পর্দার সংজ্ঞা
ইসলামী দৃষ্টিতে ‘পর্দা’ বা ‘হিজাব’ বলতে বোঝানো হয়—নারীর এমন এক জীবনাচার, যাতে সে তার শরীরকে শালীনভাবে আবৃত রাখে, অপ্রয়োজনে পুরুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে এবং তার আচরণ, চলাফেরা ও ভাষা মার্জিত হয়। এটি পুরুষদের জন্যও প্রযোজ্য, তবে নারীর পর্দা সাধারণত বেশি আলোচিত হয় কারণ তাদের শারীরিক গঠন ও সামাজিক ভূমিকাকে ঘিরে রয়েছে বাড়তি সংবেদনশীলতা।
কুরআনে পর্দার নির্দেশনা
পর্দা সম্পর্কে আল-কুরআনে স্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে:
“হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের, কন্যাদের এবং মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের চাদর দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করে। এটি তাদেরকে চেনার জন্য এবং যাতে তারা উত্ত্যক্ত না হয়।”
— (সূরা আহযাব, ৩৩:৫৯)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
“আর মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে, তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, যা আপনা-আপনি প্রকাশ পায় তা ব্যতীত। এবং তারা যেন তাদের ওড়নার এক অংশ দিয়ে তাদের বুক আবৃত করে।”
— (সূরা নূর, ২৪:৩১)
এই আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে বোঝা যায়, ইসলামে নারীর জন্য শালীনতা বজায় রেখে নিজেকে আবৃত রাখা ফরজ।
হাদীসের আলোকে পর্দা
রাসূলুল্লাহ (সা.) নারীদের পর্দা সম্পর্কে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছেন। সাহাবা ও সাহাবিয়াদের জীবন থেকে জানা যায়, তারা কিভাবে এই বিধান পালন করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, “আনসার নারীরা আয়াত নাজিলের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের চাদর দিয়ে এমনভাবে শরীর ঢাকতেন যেন তাদের চেহারা পর্যন্ত দেখা না যেত।” (আবু দাউদ)
পর্দার উদ্দেশ্য
ইসলামে পর্দার মূল উদ্দেশ্য হলো:
সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করা – নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে পরিমিত সম্পর্ক বজায় রাখা।
ফিতনা ও অশ্লীলতা থেকে রক্ষা – সমাজে ব্যভিচার, ইভটিজিং ও যৌন হয়রানির মতো অনৈতিকতা হ্রাস করা।
নারীর মর্যাদা সংরক্ষণ – নারী যেন কেবল বাহ্যিক রূপের কারণে নয়, বরং তার জ্ঞান, চরিত্র ও আচার-আচরণের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হয়।
পর্দা মানে গোঁড়ামি নয়
অনেকেই মনে করেন পর্দা মানেই নারীকে গৃহবন্দি করে রাখা। কিন্তু ইসলামে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নারী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, চাকরি করতে পারে, ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশ নিতে পারে—তবে তা ইসলামি শালীনতা ও পর্দার সীমার মধ্যে থেকে। হযরত খাদিজা (রা.) ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী এবং আয়েশা (রা.) ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষিকা।
আধুনিক সমাজে পর্দার প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান সময়ের নানা সামাজিক সমস্যা যেমন নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি থেকে বাঁচতে পর্দা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এটি নারীর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে এবং তাকে উপস্থাপন করে সম্মানজনক এক রূপে। যারা পর্দা করেন, তারা জানেন—এটি তাদেরকে মুক্তি দেয় বাহ্যিক বিচার থেকে এবং মানুষকে বাধ্য করে তাদের ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান ও মূল্যবোধ দিয়ে মূল্যায়ন করতে।
পর্দা আর বাধ্যবাধকতা
ইসলামে পর্দা একটি ফরজ ইবাদত। তবে এটি চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। বরং সচেতনতা, শিক্ষা ও আত্মার উন্নতির মাধ্যমে নারী নিজেই যেন পর্দার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন, এটাই ইসলামের উদ্দেশ্য। পর্দা হৃদয় থেকে না এলে তা হয়তো বাহ্যিক হবে, কিন্তু প্রকৃত আত্মিক পরিবর্তন আনবে না।
উপসংহার:
ইসলামে পর্দা নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং আত্মমর্যাদার প্রতীক। এটি কোনো নিপীড়ন নয়, বরং এক ধরনের সম্মানজনক পরিচয়। পর্দা নারীকে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ের কল্যাণে সহায়তা করে। একজন মুসলিম নারী যখন বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আত্মসচেতনতা থেকে পর্দা পালন করেন, তখন তা হয়ে ওঠে তার ইবাদতের অংশ।