রমজান মাসে ইবাদত-বন্দেগি

ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ যথাক্রমে কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত প্রভৃতি যেমন আল্লাহর ফরজ ইবাদত, মাহে রমজানে আল্লাহর নিয়ামত উপভোগ করে শুকরিয়া আদায় করাও অনুরূপ ইবাদত। কিন্তু কুপ্রবৃত্তি মানুষকে আল্লাহর ইবাদত করা থেকে সর্বদা বিরত রাখতে চেষ্টা করে। ইবাদত শব্দটি আরবি আবদ থেকে উদ্ভূত; এর অর্থ হলো দাস ও গোলাম। অর্থাৎ আল্লাহর দাসত্ব বা আনুগত্য করা এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করা। আরও সুস্পষ্ট করে বলতে গেলে, তিনি যা করতে বলেছেন তা করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা না করাই হলো ইবাদত। তাই সিয়াম সাধনার মাধ্যমে কুপ্রবৃত্তিগুলো দমন করে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার ও ইবাদত-বন্দেগি সম্পন্ন করতে সচেষ্ট হতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি এ জন্য যে তারা আমারই ইবাদত করবে। (সূরা আল-জারিআত, আয়াত: ৫৬)

 রমজান মাসে রোজা রাখাই ইবাদত, কারণ তা আল্লাহর হুকুম। হাদিস শরিফে রোজাকে ইবাদতের দরজা বলা হয়েছে। রমজান মাসে ইবাদত-বন্দেগির গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, হে লোক সকল! তোমাদের ওপর একটি মর্যাদাপূর্ণ মাস ছায়া বিস্তার করেছে। এ পবিত্র মাসের একটি রাত বরকত ও ফজিলতের দিক থেকে হাজার মাস থেকেও উত্তম। এ মাসের রোজাকে আল্লাহ তাআলা ফরজ করেছেন এবং এর রাতগুলোয় আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়ানোকে নফল ইবাদত রূপে নির্দিষ্ট করেছেন। যে ব্যক্তি রমজানের রাতে ফরজ ইবাদত ছাড়া সুন্নত বা নফল ইবাদত করবে, তাকে এর বিনিময়ে অন্যান্য সময়ের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব প্রদান করা হবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো ফরজ আদায় করবে, সে অন্যান্য সময়ের ৭০টি ফরজ ইবাদতের সমান পুণ্য লাভ করবে। (বায়হাকি)

বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় মাহে রমজানের ফজিলত অনেক বেশি। এ মাসে ইবাদত-বন্দেগির সওয়াব ও পুরস্কার অন্যান্য মাসের চেয়ে বহুগুণ বেশি। প্রকৃতপক্ষে রোজা এমন এক বরকতময় ইবাদত, যার সঙ্গে অন্য কোনো ইবাদতের তুলনা চলে না। নবী করিম (সা.) মাহে রমজানে দিনে রোজা রাখতেন আর রাতে দীর্ঘক্ষণ ইবাদত-বন্দেগি করতেন। সাহাবায়ে কিরামও রমজান মাসকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। মাহে রমজানে সিয়াম সাধনাকারী রোজাদারের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ পুরস্কার ও অশেষ মর্যাদা রয়েছে। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন: রোজা আমারই জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব। (বুখারি ও মুসলিম)
রমজান মাসে পবিত্র ওমরা পালন এটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।

মাহে রমজানের ওমরা আদায়ে জিয়ারতে হজের মতো সওয়াব হাসিল হয়। এ জন্য মুসলমান রোজাদারেরারমজান মাসে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে ওমরা পালন করতে পারেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেছেন, আল্লাহর কাছ থেকে মানুষের আমল বা কাজ সাত রকমের। দুই রকমের কাজ এমন যে তার ফল কাজের সমান। আর এক রকমের কাজের ১০ গুণ সওয়াব রয়েছে। এ রকমের কাজের সওয়াব ৭০০ গুণ। আরেক রকমের কাজের সওয়াব আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। প্রথম দুটি হলো: যে ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদত করে, কাউকে তার সঙ্গে শরিক করে না এবং এ অবস্থায় আল্লাহর কাছে উপস্থিত হয়, তার জন্য জান্নাত অনিবার্য। আর যে ব্যক্তি কোনো ভালো কাজ করার ইচ্ছা করে কিন্তু কাজটা করে না, সে ওই কাজ করার এক গুণ সওয়াব পায়। আর যে ব্যক্তি কোনো ভালো কাজ করে, সে তার কাজের ৭০০ গুণ পর্যন্ত সওয়াব পায়। আর রোজা আল্লাহর জন্য হয়ে থাকে। এর সওয়াবের পরিমাণ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। (বায়হাকি)

মাহে রমজানে ইবাদত-বন্দেগিতে মানুষ এত অধিক মশগুল হয়ে পড়েন যে সব ধরনের পানাহার ও ভোগ-বিলাসিতা পরিত্যাগ করে রোজাদার ব্যক্তি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল ও দোয়া-ইস্তেগফারকরে থাকেন।

 এতদ্ব্যতীত নফল নামাজ আদায়, ইফতারের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম শেষে মসজিদে দীর্ঘ জামাতের সঙ্গে খতমে তারাবি নামাজ আদায় এবং শেষ রাতে নিদ্রা ত্যাগ করে সেহেরি খাওয়া, তাহাজ্জুদ নামাজ ও ফজরের নামাজ আদায় করেন। ইবাদত হলো নামাজ-রোজা ইত্যাদির সঙ্গে যুগপৎ সৎকাজ করা। যেমন রমজান মাসে দান-সাদকা প্রদানের ক্ষেত্রেও মানুষের মনে অভূতপূর্ব উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। ফলে মাহে রমজানে ইবাদত-বন্দেগিতে নবপ্রেরণার উদ্রেক ঘটে নিঃসন্দেহে।

সিয়ামের মূল ও প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইবাদত।

 রোজারলক্ষ্য হলো আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। কেউ যদি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে অথবা অন্য কোনো কারণে কেবল পার্থিব উদ্দেশ্যে পানাহার করা থেকে বিরত থাকেন, তাহলে সেটা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না, আধ্যাত্মিকভাবেও তিনি উপকৃত হবেন না। মাহে রমজানে ইবাদত-বন্দেগিকে উদ্বুদ্ধ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের দৃঢ়তা ও পুণ্য লাভের আশায় রমজানের রোজা রেখে ইবাদত করে, তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। আর যে রমজানের রাতে ইমানের দৃঢ়তা ও পুণ্যের আশায় জাগ্রত থেকে তারাবির

নামাজ আদায় করে তার পেছনের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।

আর যে কদরের রাতে জাগে ইমানের দৃঢ়তা ও পুণ্যের আশায় তারও পেছনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম) তাই আসুন, মাহে রমজানে আমরা ইমান ও আত্মবিশ্লেষণ সহকারে নিজেদের সব কাজেকর্মে আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য প্রকাশ করি এবং ইবাদত-বন্দেগি করে পূর্বাপর গুনাহখাতা মাফ করে নিই।

 

নবীনতর পূর্বতন