খলীফার মহানুভবতা-শিক্ষণীয় গল্প | সরলপথ.কম

 

কত সুন্দর এই পৃথিবী! দেখতে কতোই না ভাল লাগে! অপরূপ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ বিচিত্র এই পৃথিবী কত আনন্দই না দান করে আমাদেরকে। উপরে নীল আকাশ,নীচে বিস্ত্ত সুবিশাল ভূমি, মাঝে মাঝে সবুজ বৃক্ষরাজির অপূর্ব সমাহার আর স্রোতের কলকল ধ্বনিসবই যেন প্রতি মুহূর্তে মহান স্রষ্টার মহিমা ঘোষনা করছে, ঘোষনা করছে তার অপার শক্তির কথা।

মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাআলা তাঁর অপরিসীম নৈপূণ্য ও শৈলীতে সৃষ্টি করেছেন 'পৃথিবী' নামক এই ধরাতল। পাঠিয়েছেন এতে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানব জাতিকে। সাথে সাথে তাদের সমূহ কল্যাণ, যাবতীয় সফলতা ও স্বীয় পরিচয় প্রকাশের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন এই জগতের বুকে অসংখ্য নবী রাসূল। আগমন ঘটিয়েছেন তাঁদের উম্মতের মাঝে এমন কিছু মহান, ব্যক্তিত্ব ও পবিত্রত্ম মানবের; যাদের অনুপম চরিত্র ও ঈর্ষনীয় জীবনাদর্শ। আমাদেরকে বিস্ময়াভিভূত করে তোলে। হৃদয়-মন থেকে নিজের অজান্তেই যেন অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে- মানব চরিত্র কি এত সুন্দর হতে পারে? মানুষের আখলাক কি এত উন্নত হতে পারে ?

যাঁদেরকে ধন-দৌলত, নেতৃত্ব ও সম্পদের প্রাচুর্য একটুও সরিয়ে আনতে পারেনি মহামহিম আল্লাহর একনিষ্ট আনুগত্য থেকে; রাজত্বের মহা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েও যারা ছিলেন একান্ত বিনয়ী; যাপন করতেন সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবন; এমনই এক মহান ব্যক্তিত্বের ছোট্ট একটি ঘটনা তুলে ধরছি প্রিয় পাঠকদের সম্মুখে।

নিঝুম রাত। চারদিকে অন্ধকার। কোথাও কোন সাড়া নেই, শব্দ নেই। সবাই ঘুমের ঘোরে সম্পূর্ণ অচেতন। নীরব-নিস্তব্ধ অমানিশার এ অন্ধকার রাতে ছোট্র একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে কাগজের বুক চিরে খস খস করে কি যেন লিখে যাচ্ছেন খলিফা উমর বিন আব্দুল আজীজ।  

পাশেই উপবিষ্ট ছিলেন একজন মেহমান । খলিফা একাগ্রচিত্তে কলমের ডগা দিয়ে বিরামহীন ভাবে লিখে যাচ্ছেন। কোন দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই ।

হঠাৎ পাশে রাখা বাতিটা নিভু নিভু হয়ে গেল। মনে হলো , এখনই তা নিভে যাবে। এ অবস্থা অবলোকন করে বাতিটা ঠিক করার উদ্দেশ্যে উপবিষ্ট মেহমান স্বীয় আসন ছেড়ে সামনে অগ্রসর হলেন। এতে খলীফা চমকে উঠলেন। সাথে সাথে তিনি মেহমানকে এই বলে নিবৃত্ত করলেন যে, "মেহমানের দ্বারা কাজ করানো ইসলামী সৌজন্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।”

একথা শুনে মেহমান অবাক বিস্ময়ে খলিফার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ তার মুখ থেকে কোন কথা বের হলো না। তিনি নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। অবশেষে সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন -

“তাহলে আপনার খাদেমকে একটু ডেকে দেই? খলিফা তাতেও বাধা দিলেন। বললেন, না, তাকে এখন ডেকে আনা কিছুতেই সমীচীন হবে না। কেননা সে অল্প কিছুক্ষণ পূর্বে ঘুমিয়েছে ।

অতঃপর খলিফা নিজ হাতে বাতিটা ঠিক করলেন। তারপর স্বীয় আসনে ফিরে এসে মেহমানকে সম্বোধন করে বললেন-“দেখুন! বাতি ঠিক করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমি যে উমর ছিলাম, এখনো সেই উমরই রয়ে গেছি।বাতি ঠিক করাতে বিন্দুমাত্রও সম্মানের হানি হয়নি আমার।"

উল্লেখিত ঘটনা থেকে আমরা তিনটি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, মেহমানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। অর্থাৎ মেহমানের খাওয়া দাওয়া ও আরামের প্রতি লক্ষ্য রাখা যেমন মেযবানের পক্ষে জরুরী তেমনি মেহমানকে দিয়ে নিজের কোন কাজ করানো ও ইসলামী সৌজন্য বোধের পরিপন্থী । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং কিয়ামতের দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন মেহমানকে সম্মান করে।"

আর দ্বিতীয় শিক্ষা হচ্ছে নিজের কাজ নিজ হাতে করাতে অসম্মানের কিছুই নেই। অর্থাৎ আমার সম্মান ও পদমর্যাদা যত উচু পর্যায়েরই হউকনা কেন, আমি যত বড় ধনীর দুলাল বা দুলালীই হই না কেন, সর্বদা একথা আমাকে খুব ভাল ভাবে স্মরণ রাখতে হবে যে, নিজের কাজ নিজের হাতে করাতে কোনই দোষ নাই, কোনই ক্ষতি নাই; বরং এতে শুধু লাভ আর লাভ। হযরত উমর বিন আব্দুল আজীজ (রহঃ) এত

বড় খলীফা হওয়া সত্ত্বেও নিজের ব্যতিখানা নিজ হাতেই ঠিক করেছেন। এতে কি তাঁর ইজ্জত সম্মান কমে গেছে? না, মোটে ও কমেনি । বরং যুগ যুগ ধরে যারাই খলিফার এ ঘটনা শ্রবণ করবে, তাদের মস্তক আপনা আপনি তার প্রতি শ্রদ্ধায় নুয়ে আসবে। তাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এ কথা হয়তো নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসবে “হযরত উমর বিন আব্দুল আজীজ (রহঃ) কতই না বিনয়ী খলিফা ছিলেন? কত বড় উদার চিত্তের অধিকারী ছিলেন তিনি!"

তৃতীয় শিক্ষা হচ্ছে- সর্বদা অন্যের আরামের প্রতি খেয়াল রাখা। চাই সে ঘরের চাকর বা চাকরানীই হউক না কেন। কেননা সেও তো মানুষ । আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আমার যেমন শান্তি ও আরামের প্রয়োজন তেমনি তারও তা প্রয়োজন। নিজেকে ঘরের কর্তা বা মনীব ভেবে কাজের ছেলে মেয়েদের উপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালনা করা, তাদের আরামের প্রতি মোটে ও খেয়াল না করে যে কোন সময় যে কোন হুকুম পালন করতে বাধ্য করা কখনোই একজন প্রকৃত মুসলমানের চরিত্র হতে পারে না। তাইতো খলিফা উমর বিন আব্দুল আজীজ (রহঃ), খাদেম সবেমাত্র ঘুমিয়েছে এখন ডাকলে তার কষ্ট হবে এ কথা চিন্তা করে তাকে ডাকতে নিষেধ করেছেন। অতঃপর খাদেমের কাজটি নিজের হাতে সম্পন্ন করেছেন । সুতরাং আমরাও কি এ মহান খলিফার ন্যায় আপন চাকর চাকরানী ও খাদেমদের প্রতি এরূপ সদাচরণ করতে পারি না?
পারিনা নিজের আরাম আয়েশের মত তাদের আরাম আয়েশের প্রতিও খেয়াল রাখতে? আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। আমীন।
নবীনতর পূর্বতন